সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করে পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে যে কাউকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান করা হচ্ছে। এর আগে করা, অসদাচরণের জন্য সরকারি কর্মচারীদের চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্তের বিধান বাদ দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলেছে, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই সংশোধন করা হচ্ছে।
লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে এ-সংক্রান্ত সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া গতকাল বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এরপর তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অধ্যাদেশ সংশোধন করা হবে।
সূত্র জানায়, অধ্যাদেশটি সংশোধন করে অনানুগত্য এবং কোনো কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে বা কাজ না করার জন্য উসকানি ও প্ররোচিত করার ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নোটিশ দিয়েই অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারবেন। সূত্র বলেছে, অধ্যাদেশের সংশোধনীতে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কমিটিতে আবশ্যিকভাবে একজন নারী রাখা হবে। তদন্তের আদেশ পাওয়ার পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে আবশ্যিকভাবে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন না দিলে তদন্ত কমিটির সদস্যদের অদক্ষতা হিসেবে গণ্য করে তাঁদের এসিআরে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রয়োজনে তদন্ত কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে।
জানা গেছে, সংশোধনীতে এই অধ্যাদেশের আলোকে কাউকে দণ্ড দেওয়া হলে দণ্ড আরোপের আদেশ পাওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। বর্তমান অধ্যাদেশে আপিল-সংক্রান্ত বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, খসড়ায় অপসারণ ও বরখাস্তের দণ্ড বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে যেকোনো সময় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যাবে। তাঁকে পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ব্যক্তি পেনশন সুবিধা পেলেও এক বছরের অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) এবং ১৮ মাসের ছুটি নগদায়নের সুবিধা পান না। এ ছাড়া সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিতে নিয়োগের অযোগ্য হন তিনি। তবে সংশোধিত চাকরি অধ্যাদেশের খসড়ায় কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে পিআরএল এবং ছুটি নগদায়নের সুবিধা দেওয়া হবে কি না, উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশনার আলোকে সেই সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি জানান।
সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী কারও চাকরির বয়স ২৫ বছর হলে কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে সরকার জনস্বার্থে তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি পেনশন, পিআরএল এবং ছুটি নগদায়নের সুবিধাসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পান।
চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করার বিধান রেখে গত ২৫ মে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কর্মচারীরা। তাঁদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ৪ জুন একটি কমিটি করে সরকার। কমিটির সদস্যরা আন্দোলনরত কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে দুই দিন বৈঠক করেছেন। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অধ্যাদেশ সংশোধন করা হচ্ছে।
বর্তমান অধ্যাদেশে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, সংশোধনীতে এ বিষয়ে নতুন একটি ব্যাখ্যা যোগ করা হচ্ছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কেউ যদি দাপ্তরিক কাজের বাইরে ব্যক্তিগত জরুরি কাজের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে না বলে কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকেন, সে জন্য চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের একজন নেতা বলেন, ‘অনানুগত্যের ধারাটি বাদ দেওয়া হচ্ছে। এটি বাদ দিলে অধ্যাদেশটি এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকেও আমাদের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। বাকি যেগুলো আছে চাকরি আইন, ২০১৮ এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর সঙ্গে মিল রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারণ দর্শানোর সুযোগ রাখা, তদন্ত কমিটি গঠন এবং নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিটিতে একজন নারী রাখার বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে। ফলে আমাদের শঙ্কার জায়গাগুলো নিরসন হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের নির্দেশনার আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের খসড়া করে। কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে এখন সরকার অধ্যাদেশে যেসব সংশোধন করতে চায়, সে বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে। ওই নির্দেশনার আলোকে সংশোধিত খসড়া করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
একাধিক জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার মতো করে বিষয়টি সংশোধন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হবে সংক্ষিপ্ত সময়ে। বর্তমান অধ্যাদেশে আপিল রিভিউয়ে অসংগতি রয়েছে, সেটি সংশোধন করছে কি না, তা দেখতে হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়ে তাঁদের চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যায়। তবে বিভাগীয় মামলা দিয়ে এভাবে দণ্ড দিতে দীর্ঘ সময় লাগে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করে অল্প সময়ের মধ্যে যে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পথ তৈরি করা হচ্ছে।
গণযোগ/এমএইচকে