ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, সমৃদ্ধকরণের ইস্যু নয়, বরং ইরানকে আত্মসমর্পণ করাতেই যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছিল।
গতকাল ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে সম্প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মুখে জোরালো চড় মেরেছি। ইরানের উদ্দেশে আত্মসমর্পণের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো ব্যক্তির মুখে শোভা পায় না। ইরানের মতো একটি মহান দেশ ও জাতির জন্য আত্মসমর্পণের কথা বলাই অপমান।’
ইরানি এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র যে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় হামলা করেছে সেগুলোয় উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি।’ ইরানি নেতা দাবি করেন, তার দেশ তাদের ঐক্য প্রদর্শন করেছে, তারা এ বার্তা পাঠিয়েছে ‘জনগণের কণ্ঠস্বর এক’।
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের দুদিন পর ভিডিও বার্তাটি দেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তিনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘জয়’ লাভ করায় ইরানি জনগণকে অভিনন্দন জানান।
ভিডিওতে আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র যে এমন হামলা চালাতে পারে, তা ইহুদিবাদী শাসকদের কল্পনায়ও ছিল না। তবু সেটাই ঘটেছে। মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করেছেন। তারা শত্রুর বহুস্তরবিশিষ্ট উন্নত প্রতিরক্ষা ভেদ করে ক্ষেপণাস্ত্র ও আধুনিক অস্ত্রের প্রচণ্ড আঘাতে শত্রুদের নগর ও সামরিক ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছেন। এ হামলা প্রমাণ করে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের খেসারত হিসেবে ইহুদিবাদী শাসকদের চরম মূল্য দিতে হবে।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন হামলার প্রসঙ্গে খামেনি বলেন, ‘এ হামলা অবশ্যই আন্তর্জাতিক আদালতে স্বাধীন আইনি পদক্ষেপের দাবি রাখে। তবে তারা এতে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘটনার বর্ণনায় অতিরঞ্জন করেছেন। আসলে তারা কিছুই অর্জন করতে পারেননি, তাদের লক্ষ্যও পূরণ হয়নি।’
খামেনি বলেন, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র তাদের প্রয়োজনে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোয় যখন ইচ্ছা তখন পৌঁছাতে পারে। এটা মোটেও ছোট কোনো বিষয় নয়।’ এ অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে আরো হামলা চালানোর হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো আক্রমণ ঘটে, তাহলে শত্রু এবং হামলাকারীদের অবশ্যই চড়া মূল্য দিতে হবে।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘ইসলামী বিপ্লবের শুরু থেকেই মার্কিনরা ইরানের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত ও দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সঙ্গে টক্কর দিয়ে আসছে। প্রতিবার তারা নতুন কোনো অজুহাত তোলে। কখনো মানবাধিকার, কখনো গণতন্ত্র রক্ষা, কখনো নারীর অধিকার, কখনো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, কখনো স্রেফ পারমাণবিক বিষয়, আবার কখনো ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন। নানা অজুহাত দেখালেও আসলে মূল কথা একটাই, ইরানের আত্মসমর্পণ। আগের আমেরিকান কর্মকর্তারা সরাসরি তা বলেননি, কারণ তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সম্পূর্ণ সফল’ হওয়ার দাবির পক্ষে নতুন গোয়েন্দা তথ্য সামনে এসেছে । দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে জানান, নতুন গোয়েন্দা তথ্য ট্রাম্পের বক্তব্যকে নিশ্চিত করেছে। তিনি আরো বলেন, ‘মার্কিন হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। যদি ইরান এগুলো পুনঃস্থাপন করতে চায় তবে নাতাঞ্জ, ফোরদো ও ইসফাহান—এই তিনটি স্থাপনাই নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এতে তাদের কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।’ এ বিষয়ে সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, একটি ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ইরানের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে এবং সেগুলো পুনর্গঠনে বহু বছর সময় লাগবে।
এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁস হওয়া প্রাথমিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান উপাদানগুলো এখনো অক্ষত আছে। হামলার ফলে তাদের কার্যক্রম সর্বোচ্চ কয়েক মাস পিছিয়েছে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যার প্রতিবাদ ইরানের: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখ্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি এ ব্যাখ্যাকে ‘আইনিভাবে ভিত্তিহীন’ বলে অভিহিত করেছেন।
চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ‘অবৈধ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে ইরান। একই সঙ্গে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের হত্যা’ বলে অভিহিত করা হয়। চিঠিতে ইরাভানি উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাধারণ সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কিংবা হামলার হুমকি আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে।
গণযোগ/এমএইচ