চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ঢাকার বাসা বাড়ীতে লাভার বিস্তার থেমে নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক সানায়া তাহমিনা বলেছেন, সম্প্রতি একটি জরিপে তারা দেখেছেন ঢাকায় বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার জীবাণুবাহী এডিস মশা জন্মের হার বাড়ছে এবং এর ফলে এবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের চেয়ে বেশি হওয়ার আশংকা রয়েছে।
একটি বিদেশী গণমাধ্যমে তিনি বলেন, "আমরা বছরে তিনবার এই জরিপ করি: একটা প্রি-মনসুন মানে বর্ষা শুরু হবার আগে, একটি বর্ষা মৌসুমে এবং আরেকটি বর্ষার পরে। মার্চে যে প্রি-মনসুন জরিপ চালিয়েছি তাতে দেখা গেছে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক ঢাকায় এখন ২২ শতাংশ।"
ঈদুল আজহার আগে দুই সপ্তাহ ধরে চলা একদল গবেষকের আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে ৭ থেকে ৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে। এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়।
লার্ভা জরিপে যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটি হলো লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ করা। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। যদি এই ইনডেক্সের পরিমাণ ২০-এর বেশি হয়, তবে তা আশঙ্কাজনক বলে বিবেচিত হয়। এখন এই জরিপ অনুযায়ী, ব্রুটো ইনডেক্সের হার ৫০ থেকে ৬০।
এই জরিপের নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এবার এডিস মশার বংশবৃদ্ধির হার মারাত্মক। মশার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।’
দক্ষিণ ও উত্তর দুই সিটিতেই এডিস মশার প্রকোপ সমান হারে বাড়ছে বলে জানান কবিরুল বাশার।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত যতজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, এর সংখ্যা গতবারের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু বৃদ্ধির ‘আদর্শ’ পরিস্থিতি রয়েছে। কারণ হিসেবে আবহাওয়া পরিস্থিতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতার অভাব এবং সর্বোপরি সরকারের প্রস্তুতির অভাবকে তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের গতকাল সোমবার (৯ জুন) পর্যন্ত দেশে ৪ হাজার ৯৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৩ জন। গত বছর এ সময় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩১। এ সময় মারা গিয়েছিলেন ৩৭ জন। দেশে এযাবৎকালে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় ২০২৩ সালে। ওই বছরের ৮ জুন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৮৫৪ জন। আর মারা গিয়েছিলেন ২১ জন। পুরো বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। আর মারা গিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০৫ জন। দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে নতুন করে প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এরপর পরবর্তী ২৩ বছরে এত সংক্রমণ বা মৃত্যু হয়নি, যা ২০২৩ সালে হয়েছিল।
এখনকার আবহাওয়া পরিস্থিতি বড় সংক্রমণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভ্যাপসা গরম। এটা ডেঙ্গুর এডিস মশা বৃদ্ধির একেবারে আদর্শ অবস্থা।
গত মে মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। চলতি মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এবং এর সঙ্গে আবার তাপপ্রবাহও আছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি বাড়তে পারে। এমনকি সাগরে আবারও নিম্নচাপ সৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বলছিলেন, এডিসের বংশ বিস্তারে তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উপযোগী। মে মাসে বিশেষ করে রাজধানীতে তাপমাত্রা কম থেকেছে, আবার বৃষ্টিও হয়েছে থেমে থেমে। এমন অবস্থা বংশ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে।
শুধু এডিস নয়, বিশেষ করে রাজধানীতে এ বছর কিউলেক্স মশারও ব্যাপক বিস্তার ঘটে। গত মার্চে রাজধানীর গুলশানে মশার অবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সাইফুর রহমান। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৯০০ থেকে ২ হাজার মশা পাওয়া যায় ওই এলাকায়।
সাইফুর রহমান বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ২০০-এর মতো মশা পাওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার। মার্চ মাসের পর বৈশাখী ঝড়বৃষ্টির কারণে কিউলেক্স কিছু কমে আসে। কিন্তু এখন ডেঙ্গু এবং কিউলেক্স উভয়ই বেড়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি এবার যেমন, তাতে ডেঙ্গুর একেবারে সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
চলতি বছর রাজধানীর চেয়ে বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেশি। দেশের মোট আক্রান্তের ২৫ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। বিভাগের হিসাবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ বরিশাল বিভাগে, ১ হাজার ৯৯৪ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত বছর এ সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০২, এ বছর ৭৭৭। উত্তরে সংখ্যা ছিল ৪৩৮, এবার ৪৬৯।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো বাড়তে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রস্তুতি আছে। বাজেটও আছে। ঈদের ছুটির জন্য তৎপরতা বন্ধ ছিল। আবার তা জোরেশোরে শুরু হবে।’
কীটতত্ত্বববিদ তৌহিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলোর তৎপরতায় খুব আশা দেখছেন না , বর্তমানে রোগীর সংখ্যা এবং মশার বিস্তার বলে দিচ্ছে, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেও সক্রিয় নয়। আগে তা-ও কিছু কাজ চোখে পড়ত, এখন নেই। এখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের আট তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৯৫। এটি কেবল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে এপ্রিলে দুজন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন।
কিন্তু গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩৩জ
গণযোগ/এমএইচ